বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) উৎপাদিত বিটুমিনের চাহিদা অনেক বেশি থাকায় সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে কিনতে পারা কঠিন হয়ে গেছে। মানসম্মত এ বিটুমিনের ব্যবসায় সিন্ডিকেটের এ দাপটের চিত্র উঠে এসেছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিপিসি পরিচালক (মার্কেটিং) অনুপম বড়ুয়া এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের খালাতো ভাই মোহাম্মদ ইউসুফ ওরফে ইউসুফ আলী এ সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। এর বাইরে আরও অন্তত চারজন রয়েছেন, যারা আলাদা কিংবা কখনো এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলে বিটুমিন কারসাজি করেন। তারা হলেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আলী লিটন, মোহাম্মদ কামরুল, মোহাম্মদ কামাল হোসেন এবং মোহাম্মদ পারভেজ।
এসব বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের সঙ্গে কথা হয় গণমাধ্যমের। ইউসুফকে নিজের খালাতো ভাই স্বীকার করে তিনি বলেন, দুই বছর আগে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পর তাকে সতর্ক করেছি। এরপরও আমার নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা করার প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেব।
পরিচালক অনুপম বড়ুয়ার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তাই এখনই কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তিন মাসেও তদন্তকাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে তার মন্তব্য এটা সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশে কোনো তদন্তই তো আলোর মুখ দেখে না। তিনি বলেন, বিটুমিন নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। এতে বিপিসির ইমেজ নষ্ট হয়। কিন্তু এর উৎপাদন বন্ধ হলেও বিপিসির কোনো ক্ষতি নেই।
সূত্রমতে—বছর দেড়েক আগে বিপিসির পরিচালক হিসেবে যোগ দেন অনুপম বড়ুয়া। এর কিছুদিন পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আসতে থাকে। সরকারি বিটুমিন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায়ের অভিযোগ এনে ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে।
গত ১৩ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে বিষয়টি অবহিত করে। এরপর অনুপম বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও জ্বালানি বিভাগকে অবহিত করার জন্য ৩০ এপ্রিল বিপিসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়।
জ্বালানি বিভাগের উপসচিব একেএম মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করতে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হককে দায়িত্ব দেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে বিপিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে অনুপম বড়ুয়া বলেন, এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে আমার বক্তব্য দিয়েছি। এর বাইরে কোনো মন্তব্য নেই। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং যিনি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন তারা দুজনই সরকারের যুগ্ম সচিব। তিন মাস পরও তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় এ নিয়ে নানারকম প্রশ্নও উঠেছে।
সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতি বছর দেশে বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮ থেকে ৯ লাখ টন। ইআরএলের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৭০ হাজার টন। কিন্তু গড়ে উৎপাদন হয় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টন। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল, এশিয়াটিক স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ও ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের মাধ্যমে এ বিটুমিন বিক্রি করে ইআরএল।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কারসাজির মাধ্যমে সরকারি বিটুমিন বরাদ্দ নেয়। পরে তার সঙ্গে নিম্নমানের আমদানিকৃত বিটুমিন মিশিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে। অনেকে আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই থেকে উন্নত মানের বিটুমিন আমদানির কথা বলে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে বাস্তবে সেখানে বিটুমিন কারখানা নেই।
সরকারি বিটুমিন কিনতে সরকারের যে দপ্তরের কাজ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে সেই কার্যালয়ের কার্যাদেশসহ অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়। যাচাই-বাছাই শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত যেকোনো বিতরণ কোম্পানির নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিটুমিনের দাম পরিশোধ করতে হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে সিরিয়াল অনুযায়ী বিটুমিন সরবরাহ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত লেগে যায়। এজন্য অনেকেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়তি টাকা দিয়ে বিটুমিন কেনেন। কয়েকজন মধ্যস্বত্বভোগী, বিপিসি ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলেমিশে বাড়তি টাকার ভাগ নেন। ঠিক কী পরিমাণ অবৈধ অর্থ লেনদেন হয় তার সুনির্দিষ্ট চিত্র পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে যে ধারণা মিলেছে, তাতে এর পরিমাণ বছরে গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিভাগের একাধিক সূত্রমতে, বিপিসি এবং এর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্য হিসেবে ইউসুফকে দেখা যায়। সামনের দিকে পরিবারের জন্য নির্ধারিত সারিতেই তার বসার ব্যবস্থা থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, দুই বছর আগে ইউসুফকে সতর্ক করেছেন বলে চেয়ারম্যানের যে দাবি সেটি যদি সত্যি হয় তাহলে এরপরও তিনি কীভাবে এ অপকর্ম করে যাচ্ছেন? এর পেছনে রহস্য থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।
সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে বিটুমিন কেনার সিরিয়াল দ্রুত পাইয়ে দিতে ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিরিয়াল পেতে সমস্যা হবে না। তবে যমুনা থেকে নেওয়া যাবে না। কারণ ওরা একটা ফরম্যাটে চলে গেছে। যদি পদ্মা থেকে মাল নিতে চান তাহলে এমডির সঙ্গে কথা বলব। ঢাকার মালিবাগ এলাকায় আবুল হোটেলের কাছে আমার অফিস। আসেন, সরাসরি কথা হবে।
বাড়তি খরচ কেমন? জবাবে হাসি দিয়ে ইউসুফ বললেন, আমার কাছ থেকে অনেকেই মাল নেয়। যেমন কর্ণফুলী টানেলে আমি অনেক মাল দিয়েছি। টনপ্রতি একটা হিসাব করে আমাকে টাকা দিয়েছে তারা। এখানে তো আমি একা (আবার হাসি) করতে পারব না। যে কোম্পানি থেকে নেবেন সেই কোম্পানির এমডি, ইআরএলের লোকজন আছে। তাদের সঙ্গে আমি আগে একটু কথা বলি।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি বলেন, ইআরএল এবং বিভিন্ন কোম্পানিকে ম্যানেজ করে বিপিসি। তারা তো বিপিসির কথা ছাড়া সিরিয়ালে হাত দিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে আমি কাকে ব্যবহার করব সেটা আমার বিষয়।
আপনি তো বিপিসির চেয়ারম্যানের ভাই, তাই না? আবার হাসি দিয়ে ইউসুফ বলেন, আপনি আমাকে খুঁজে বের করেছেন। আপনিই জানেন আমি কে? আসলে এর আগে নানারকম ঝামেলা হয়েছে। ব্যাপারটা খুব সেনসিটিভ (স্পর্শকাতর)। আপনারা যদি বেশি পরিমাণে মাল নেন, তাহলে আপনাকে সহযোগিতা করব।
একপর্যায়ে নিজেকে চেয়ারম্যানের আপন খালাতো ভাই পরিচয় দিয়ে বলেন, অনেক বছর ধরে ব্যবসা করছি। তা প্রায় চার-পাঁচ বছর। এর মধ্যে উনি (চেয়ারম্যান) আসছেন। এতে প্লাস পয়েন্ট হয়েছে। ব্যবসা বড় করতে চাইলে সুযোগ আছে।
ব্যবসা বড় করতে বিপিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসানোর প্রস্তাবে ইউসুফ বলেন, আপনাদের সঙ্গে আগে আমার বসতে হবে। জ্বালানি খাতে আমাদের আরও অনেক ব্যবসা আছে। চাইলে আপনারাও করতে পারবেন। চেয়ারম্যান আগামী এপ্রিল পর্যন্ত আছেন। এপ্রিলের পর এ চেয়ারম্যান না থাকলে তখন কী হবে? অভয় দিয়ে বললেন, আপনার পথ আমিই বাতলে দেব। ইআরএলের অনেক কর্মকর্তা, বিপিসির পরিচালকরা আছেন, যারা আমার পরিচিত। আমি উনার (বিপিসির চেয়ারম্যান) ভাই হলেও সবাইকে ম্যানেজ করেই চলি।
ইউসুফের সহযোগী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী লিটন। তাকে ফোন দিয়ে ইআরএলের বিটুমিন কেনার আগ্রহ প্রকাশ করতেই সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন, দেওয়া যাবে। আমার নম্বর কি ইউসুফ ভাই দিয়েছেন? কোন ইউসুফ? জবাবে বললেন, বিপিসির চেয়ারম্যান স্যারের ভাই। তার সঙ্গে আমার ভালো রিলেশন। একসঙ্গেই ব্যবসা করি। উনি যেহেতু আছেন ইনশা আল্লাহ সিরিয়াল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বাকি আল্লাহ ভরসা।
একটা হাসি দিয়ে এবার লিটন বললেন, ব্যবসা আরেকটা আছে। যেমন সড়ক ও জনপথ এবং এলজিইডির ডকুমেন্ট থাকলে সেটা দেখিয়ে আপনার নামে বিটুমিন নিয়ে অন্য জায়গায় বাড়তি দামে বিক্রি করে দিলেন। এতে সবাই মিলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। আমরা যাদের মাল দিই তারা অধিকাংশই ব্যবসা করে এভাবে। অনেকে গুদামজাত করে বেশি দামে বিক্রি করে।
প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে টাকা লাগে। টাকা না দিলে কী কাজ হয় ভাইজান? ২৩ বছর ধরে ব্যবসা করছি। এ লাইনে ব্যবসা করে অনেকে আজ কোটিপতি। কিন্তু আমি এখনো ফকির। চিটারি, বাটপারি করি না। কাউকে খারাপ পরামর্শ দিই না’ যোগ করেন লিটন।
তিনি বলেন, বিপিসির তিনজন পরিচালকের মধ্যে একজনকে ম্যানেজ করতে হবে। এটা নিয়ে সমস্যা হবে না। ডকুমেন্ট ছাড়া মাল নিতে হলে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেবেন। যেকোনো একটা কোম্পানি থেকে আপনাকে মাল দেওয়া হবে।
ইউসুফ-লিটন সিন্ডিকেটের বাইরে আরেক হোতা মোহাম্মদ কামাল হোসেন। তিনি বলেন, যারা সরকারি দামের অতিরিক্ত টাকা দেয় তাদের কোনো সিরিয়াল লাগে না। যেদিন পে-অর্ডার দেবেন ওইদিনই মাল পাবেন। সরকারি দরের অতিরিক্ত কত টাকা দেবেন, সেটা মাল নেওয়ার আগে জানাব।
বিটুমিন কিনতে এবার যোগাযোগ হয় মোহাম্মদ পারভেজ নামে আরেকজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পে-অর্ডারের টাকা জমা দিয়ে গাড়ি নম্বর দেবেন, মাল চলে যাবে। সিরিয়াল নিয়ে ভাববেন না। সবাইকে ম্যানেজ করেই কাজ করি। বাড়তি টাকা আলাদা অ্যাকাউন্টে দেবেন। এ টাকা শুধু আমরা একা নিই না, কিছু ম্যানেজারদেরও দেওয়া লাগে।
বিটুমিন কারসাজির আরেক হোতা মোহাম্মদ কামরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও আশ্বাস দিলেন, বাড়তি টাকা দিলে সিরিয়াল পেতে কোনোরকম সমস্যা নেই।
সূত্র—ডিআর/সকালের-সময়/ফোরকান